আড়াই হাজার বছর পূর্বের কথা। হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নামে একটি রাজ্য ছিল। সে রাজ্যে শাক্যবংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন। এ রাজ্যের রাজা ছিলেন শুদ্ধোদন রানির নাম ছিল মহামায়া। মহামায়া এক বৈশাখী পূর্ণিমার দিন বাপের বাড়ি দেবদহ যাচ্ছিলেন। রানি লুম্বিনী উদ্যানে উপস্থিত হলেন। এমন সময় রানি এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। বহুদিন পর রাজা-রানির মনোবাসনা সিদ্ধ হওয়ায় নবজাত পুত্রের নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ। জন্মের সাত দিন পর মাতা মায়াদেবী মারা যান। বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী কর্তৃক লালিত-পালিত হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম হয় গৌতম। শাক্যবংশে জন্মগ্রহণ করায় অমাত্য ও প্রজাগণ নাম রাখলেন শাক্যসিংহ ।
শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েই সাত পা হেঁটে সামনে গেলেন। সাত পায়ের নিচে সাতটি পদ্ম ফুটল। সপ্ত পদ্মে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন— "জগতে আমিই জ্যেষ্ঠ; আমিই শ্রেষ্ঠ ।”
নবজাত শিশুটি দিন দিন বড় হতে লাগল। তাঁর মাঝে চপলতা ছিল না। সব সময় নির্জনে বসে বসে যেন কী ভাবতেন। একদিন রাজা শুদ্ধোদন সিদ্ধার্থ গৌতমকে সংগে নিয়ে হাল কর্ষণ উৎসবে যান। হালচাষের কারণে মাটির ভিতর হতে অনেক পোকা-মাকড় উঠছিল। ব্যাঙেরা সে পোকা-মাকড় খাচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে রাজকুমারের মনে দুঃখ হলো। নিরীহ প্রাণীর প্রতি রাজকুমারের মন দুঃখে ভরে গেল । মনে করুণা হলো। তখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ জম্বুবৃক্ষের নিচে বসে জীবের দুঃখের কথা ভাবছিলেন।
সিদ্ধার্থ গৌতম অন্য একদিন বিকেল বেলায় একটি ফুলবাগানে নির্জনে বসে যেন কী ভাবছিলেন। এমন সময় একটি হাঁস তাঁর সামনে এসে পড়ল। হাঁসটির বুকে একটি তীর বিদ্ধ ছিল। সিদ্ধার্থ গৌতম হাঁসের বুক হতে তীরটি খুললেন। হাঁসটিকে সুস্থ করলেন।
এমন সময় সিদ্ধার্থের মামাতো ভাই দেবদত্ত তাঁর সামনে আসল। এসে সিদ্ধার্থ গৌতমকে বলল, “হে সিদ্ধার্থ! এ হাঁসটি আমার। হাঁসটি আমায় দিয়ে দাও।' তখন সিদ্ধার্থ গৌতম বলল, ‘ভাই দেবদত্ত, তুমি! প্রাণহরণকারী, আমি প্রাণদাতা। আমি শাক্যরাজ্য তোমাকে দিতে রাজি আছি। তবুও এ হাঁসটি তোমায় দেব না।' কুমার সিদ্ধার্থ একথা বলে হাঁসটিকে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। হাঁসটি প্যাক প্যাক শব্দ করতে করতে আকাশে উড়ে গেল । সিদ্ধার্থ গৌতম বাল্যকালে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে চৌষট্টি রকমের লিপি শিক্ষা করেন। ত্রিবেদসহ নানা শাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন। অশ্বারোহণ, রথচালনা, ন্যায়শাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্রসহ ধনুর্বিদ্যায়ও পারদর্শিতা অর্জন করেন।
সিদ্ধার্থ গৌতম কৈশোরকাল অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেন। তাঁর উনিশ বছর বয়স হলো। তিনি সব সময় নির্জনে বসে চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। এজন্য রাজা শুদ্ধোদন সিদ্ধার্থ গৌতমকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যশোধরা নাম্নী এক ক্ষত্রিয় কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করান। কিন্তু এতেও সিদ্ধার্থের মন সংসারের প্রতি আকৃষ্ট হলো না। জীবের দুঃখ কীভাবে দূর করবেন, নীরবে বসে ভাবতেন।
সিদ্ধার্থ গৌতম সারথি ছন্দককে সংগে নিয়ে চার দিন নগর ভ্রমণে বের হন। জরাগ্রস্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, মৃতদেহ এবং একজন সন্ন্যাসী দেখলেন। জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর হাত হতে রক্ষার জন্য সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণই উচিত মনে করলেন। তিনি আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনই গৃহত্যাগ করবেন বলে সংকল্প গ্রহণ করেন ৷
সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। যশোধরা একটি পুত্র প্রসব করেন। পুত্রের নাম রাখা হয় রাহুল। যশোধরা গভীর রাতে নবজাত শিশুকে কোলে নিয়ে সোনার পালঙ্কে ঘুমাচ্ছেন। এ মুহূর্তে সিদ্ধার্থ গৌতম সারথি ছন্দককে ডাকলেন। কত্থক নামক অশ্ব সাজিয়ে আনতে আদেশ দেন। সারথি ছন্দক অশ্ব সাজিয়ে আনল। তখন সিদ্ধার্থ গৌতম যশোধরার শয়ন- কক্ষে প্রবেশ করলেন। নবজাত শিশুকে এক পলক দর্শন করে গৃহত্যাগ করলেন।
রাত পোহাল। সিদ্ধার্থ গৌতম ছন্দককে সংগে নিয়ে অনোমা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। অশ্ব হতে নেমে সিদ্ধার্থ গৌতম তলোয়ার দ্বারা মাথার চুল কাটলেন। সেই চুল আকাশে উড়িয়ে দিলেন।
এরপর সিদ্ধার্থ গৌতম নিজ দেহ হতে সমস্ত রাজকীয় পোশাক খুলে ফেললেন। পোশাকগুলো ছন্দককে দিয়ে বিদায় দিলেন। ছন্দক কপিলাবস্তু নগরে ফিরে আসল । সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগের সংবাদ সকলকে জানাল। নগরবাসী গৃহত্যাগের কথা শুনে কাঁদল ।
তারপর সিদ্ধার্থ গৌতম ঋষি আড়ার কালামের আশ্রমে গেলেন। পরে রাজগৃহের ঋষি রুদ্রক রামপুত্রের আশ্রমে গমন করেন। উভয় স্থানে কিছুদিন সাধনা করেন। তাঁদের সাধন পথে সাধনার দ্বারা দুঃখ মুক্তি সম্ভব নয় বুঝলেন। তাই এ দুজন ঋষিকে ত্যাগ করে নিজেই সাধনা করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর সিদ্ধার্থ গৌতম সাধনা করার উদ্দেশ্যে গয়ার অদূরে পাহাড়ের গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। অনাহারে শরীরের রক্ত-মাংস শুকিয়ে গেল। শরীর দুর্বল হয়ে গেল। তখন তিনি বুঝলেন সত্যকে লাভ করতে হলে আত্ম-নিগ্রহ এবং ভোগ-বিলাসের পথ ত্যাগ করে মধ্যম পথ অবলম্বন করতে হবে।
দুর্বল দেহ নিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতম সেনানী নামক গ্রামে উপস্থিত হলেন। একটি বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষের গোড়ায় আসন পেতে বসলেন। এমন সময় সেনানী গ্রামের কুলবধূ সুজাতা স্বর্ণ থালায় পায়সান্ন নিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতমের হাতে তুলে দিল। সিদ্ধার্থ গৌতম পায়সান্ন আহার করে নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করেন। তারপর উরুবিল্ল গ্রামে গমন করেন। সেখানে উন্মুক্ত স্থানে একটি বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ ছিল। সে বৃক্ষের নিচে পূর্বমুখী হয়ে বজ্রাসনে বসলেন।
সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। তিনি বজ্রাসনে বসে সংকল্প গ্রহণ করলেন—‘এ আসনে আমার রক্ত-মাংস শুকিয়ে যাক। শরীর বিনষ্ট হলেও পরম বোধিজ্ঞান লাভ না করে এ আসন ছেড়ে উঠব না।' এমন সময় পাপমতি মার ভীষণ আকৃতি ধারণ করে সিদ্ধার্থের সামনে আসল। সহস্র হস্তে অস্ত্র নিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতমকে আক্রমণ করল। তাঁকে লক্ষ্য করে উত্তপ্ত শিলাবৃষ্টি বর্ষণ করল। কিন্তু সিদ্ধার্থ গৌতম আসন ছেড়ে উঠলেন না। তখন পাপমতি মার আপন যুবতী কন্যা রতি, আরতি ও তৃষ্ণাকে গৌতম সিদ্ধার্থের ধ্যান ভঙ্গ করার আদেশ দিল। কিন্তু তিনি সাধনায় স্থির রইলেন। পাপমতি মার ব্যর্থ হয়ে সিদ্ধার্থের সামনে থেকে চলে গেল।
এদিকে বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল। রাত্রির তৃতীয় যামে সিদ্ধার্থ গৌতম সর্ব তৃষ্ণা ক্ষয় করে বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হন। তিনি বুঝলেন তৃষ্ণাই জন্মের কারণ। আবার জন্মই সকল দুঃখের মূল। তৃষ্ণার মূল ছেদন করতে পারলেই পরম সুখ নির্বাণ লাভ সম্ভব। তিনি বৈশাখী পূর্ণিমার দিন বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন। যে স্থানে বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হন, সে স্থানটি বুদ্ধগয়া নামে পরিচিত।
বুদ্ধ হওয়ার পর তিনি চিন্তা করলেন, আমি যে ধর্ম লাভ করেছি তা অতি গভীর ও দুর্বোধ্য। জ্ঞানীগণ ব্যতীত সাধারণ মানুষ এ ধর্ম বুঝবে না। এ কারণে ধর্ম প্রচার করবেন না বলে সংকল্প গ্রহণ করলেন। সে সময় সহম্পতি ব্রহ্মা প্রার্থনা করলেন, হে ভগবান বুদ্ধ, আপনি ধর্ম প্রচার করুন। অনেকে আপনার সাধনালব্ধ ধর্ম বুঝবে।
তখন ভগবান বুদ্ধ প্রথম কার নিকট ধর্ম প্রচার করবেন চিন্তা করলেন। তিনি প্রথম আড়ার-কালাম ও রুদ্রক রামপুত্রের নিকট ধর্ম প্রচার করার কথা চিন্তা করলেন। কিন্তু তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। তাই তিনি প্রথম জীবনের সংগী পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট ধর্ম প্রচার করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তাই বুদ্ধ সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে গেলেন ৷
সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। তিনি পঞ্চবর্গীয় শিষ্য-কৌণ্ডিন্য, ভদ্দিয়, বপ, মহানাম ও অশ্বজিতের নিকট সর্বপ্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। তিনি শিষ্যদেরকে বললেন— ‘হে ভিক্ষুগণ, প্রব্রজিতদের জন্য সাধন পথে দুটি অন্তরায় পরিত্যাগ করা উচিত। আত্মপীড়ন না করা এবং অতি ভোগ-বিলাসের পথ ত্যাগ করা।' সাধনার জন্য মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা সাধকদের কর্তব্য। সে মধ্যম পথ হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ। যথা-সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক চেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। চতুরার্য সত্যই জগতের প্রকৃত সত্য। তা উপলব্ধি করে সাধনা করাই সাধকদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সিদ্ধার্থ গৌতম সকল প্রাণীর মঙ্গলের জন্য সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধর্ম প্রচার করেন। বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধে বিভক্ত।
বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভের পূর্বে আয়ুষ্মান আনন্দকে সংগে নিয়ে কুশীনগর গমন করেন। মল্ল রাজাদের যমক শালমূলে উত্তর শিয়রে শয়ন করেন। এমন সময় দেবতাগণ বুদ্ধের ওপর পুষ্প বৃষ্টি আরম্ভ করেন। তখন বুদ্ধ আনন্দকে লক্ষ করে বললেন- “হে আনন্দ, পুষ্প বৃষ্টির দ্বারা প্রকৃত পক্ষে বুদ্ধকে পূজা করা হয় না। যে বুদ্ধের উপদেশ সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মভাবে নিজ জীবনে আচরণ করে,এর দ্বারাই প্রকৃত বুদ্ধ পূজা হয়।’
ভগবান বুদ্ধ এরূপ উপদেশ প্রদান করে ধ্যানস্থ হন। প্রথম ধ্যান হতে দ্বিতীয় ধ্যানে, দ্বিতীয় ধ্যান হতে তৃতীয় ধ্যানে এবং সর্বশেষ চতুর্থ ধ্যানে উপনীত হয়ে পরিনির্বাণ লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল আশি বছর। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি ।
১. শিশুটি ___ হয়েই সাত পা হেঁটে সামনে গেল।
২. এমন সময় একটি হাঁস তাঁর সামনে এসে ___।
৩. সিদ্ধার্থ গৌতম বাল্যকালে অত্যন্ত ___ ছিলেন।
8. ___ দুঃখ কীভাবে দূর করবেন নীরবে বসে ভাবতেন ।
৫. নবজাত শিশুকে এক পলক ___ করে গৃহত্যাগ করেন।
বাম | ডান |
---|---|
১. সিদ্ধার্থ গৌতম বাল্যকালে ২. তিনি সব সময় নির্জনে বসে ৩. সারথি ছন্দক ৪. সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের ৫. এ আসনে আমার ৬. সিদ্ধার্থ গৌতম সর্ব তৃষ্ণা ক্ষয় | ১. অশ্ব সাজিয়ে আনল ৷ ২. সংবাদ সকলকে জানাল। ৩. রক্ত-মাংস শুকিয়ে যাক। ৪. করে বোধিজ্ঞান লাভ করেন। ৫. অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ৬. চিন্তামগ্ন থাকতেন। ৭. সফরে গেলেন। |
১. সিদ্ধার্থ গৌতমের বাল্যকালে কী কী নাম ছিল ?
২. সিদ্ধার্থ গৌতম বুকে তীরবিদ্ধ হাঁসটিকে কী করলেন ?
৩. সিদ্ধার্থ গৌতম বাল্যকালে কোন কোন বিদ্যা শিক্ষা করেন?
৪. পাপমতি মার সিদ্ধার্থ গৌতমকে কীভাবে আক্রমণ করল?
৫. পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নাম লেখ।
৬. বুদ্ধ পরিনির্বাণের সময় আনন্দকে উদ্দেশ করে কী উপদেশ দেন ?
১. সিদ্ধার্থ গৌতমের বাল্য জীবনের একটি ঘটনা বর্ণনা কর।
২. সিদ্ধার্থ গৌতমের গৃহত্যাগের বর্ণনা দাও।
৩. সুজাতার পায়সান্ন দানের বিবরণ দাও ।
৪. সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভের ঘটনা বর্ণনা কর।
৫. বুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তনের বর্ণনা দাও।
কপিলাবস্তু
নালন্দা
রাজগীর
সারনাথ
Read more